চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
দেশে বিভিন্ন সময়ে ভূয়া ওয়ারেন্ট বা নামের মিল থাকা বা নাম বিভ্রাটের কারণে নিরীহ নিরাপরাধ লোকজনের কারাভোগের ঘটনায় চরম উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন- বিএইচআরএফ ।
আজ ৬ অক্টোবর সংগঠনের চেয়ারপার্সন ও প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান, মহাসচিব রাজীব সামদানী, ডাইরেক্টর (অর্গানাইজিং) এডভোকেট জিয়া হাবীব আহ্সান, ডাইরেক্টর (ফিন্যান্স) আহমেদ মেহেদী সামদানী ও পরিচালক সদস্য অংশু আসিফ পিয়াল প্রমুখ বি.এইচ.আর.এফ নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা গভীর উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ্য করছি যে, শুধুমাত্র নামের মিল ও নাম বিভ্রাটের কারণে কিছু নিরীহ, নিরাপরাধ নারী পুরুষকে কারাভোগ ও চরম হয়রানীর শিকার হতে হচ্ছে।’
বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসার পরেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না এবং ক্ষতিগ্রস্থদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না । অথচ নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ও মৌলিক অধিকার রক্ষায় দায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে ।
বিবৃতিতে তারা আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনা দোষে বছরের পর বছর কারাদণ্ড ভোগ করার বহু নজির রয়েছে । যা বন্ধ হওয়া দরকার । ভুয়া ওয়ারেন্টে নিরাপরাধ ব্যক্তির হাজতবাসের ঘটনা ও ইতিমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে ।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করে তারা আরো বলেন, ‘সম্প্রতি চট্টগ্রামে দেখা গেছে অপরাধ না করেও দেড় বছর কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পায় হাসিনা বেগম (৪০) নামের এক নিরীহ নারী ।জামিনে যাওয়ার পর মাদক মামলায় ৬ বছরের সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামী হাসিনা আক্তারের বদলে সাজা ভোগ করে টেকনাফের এই নিরাপরাধ নারী । তিনি ইতিমধ্যে মুক্তি পেলেও তার সবকিছু তছনছ হয়ে যায় ।
অপরদিকে নিজের নাম ও স্বামীর নাম মিল থাকায় ঢাকার পল্লবী থানার মিরপুর ১১ নং বাউনিয়াবাঁধ এলাকার রাহিমা বেগম নামক এক গরীব মহিলা মাদক মামলায় একাধিকবার জেল খাটেন । যার কারণে তাকে এলাকায় মানহানীরও শিকার হতে হয় ।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে স্ত্রী ও দেড় বছরের সন্তানকে নিয়ে বিছানায় বসে খাবার খাচ্ছিলেন হালুয়াঘাটের মনিকুড়া গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী রাজিব মিয়া । এ সময় হঠাৎ হালুয়াঘাট থানা পুলিশ ঘরে ঢুকে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলার ওয়ারেন্ট আছে বলে হাতকড়া পরিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় । পরদিন আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে। অস্ত্র মামলায় এক বছর নয় মাস জেল খাটা পলাতক এক আসামির সঙ্গে নামের মিল থাকায় এই পরিণতির শিকার হতে হয় তাকে ।
৩ মাস কারাভোগের পর মুক্তি পায় প্রতিবন্ধী রাজিব মিয়া ।২০১৫ সালে কোতোয়ালী থানায় ডাকাতি ও অস্ত্র মামলায় আসামী মঃ রাজিবের ঠিকানা লেখা হয় হালুয়াঘাটের মনিচুড়া । তবে চার্জশীটে লিখা হয় সঠিক ঠিকানা শেরপুর জেলার মালিতা বাড়ীর বিজগিরি পাড়া।
মানবাধিকার তথ্যানুসন্ধানে আরো দেখা যায় যে, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামের এক নারী খুনের মামলায় রায়ের দিন অপরাধী কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত না থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়নাসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
পরে ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামের এক মহিলাকে সাজাপ্রাপ্ত আসামী কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানো হয় অথচ সে কুলসুমী নামের কাউকে চিনে না এবং এই মামলার সাথে তার কোন সম্পৃক্ততা নেই ।
২০১৭ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ইয়াবাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় হাসিনা আক্তারের কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। তবে নামের একাংশের সঙ্গে মিল থাকায় তার জায়গায় প্রায় দেড় বছর ধরে সাজা খাটছেন হামিদ হোসেনের স্ত্রী হাছিনা বেগম। নামে মিল থাকায় বিনা দোষে গত দেড় বছর ধরে চট্টগ্রাম কারাগারে ছিলেন। টেকনাফের হাছিনা বেগম (৪০)। মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি একই এলাকার হাসিনা আক্তারের বদলে আটক করে পুলিশ আদালতে চালান করেন ভুক্তভোগী হাছিনা বেগমকে। এরপর থেকেই স্বামী-সন্তান ছেড়ে বিনা দোষে জেল খাটছিলেন তিনি ।
বিএইচআরএফ আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদের তথ্যানুসন্ধ্যানে তা প্রকাশ পায় ও তিনি উক্ত ভিকটিমের জামিনের আবেদন করে তাকে মুক্তি করেন ।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের করা এক মামলার তদন্তে মূল আসামির নাম ও তার বাবার নামের সাথে মিল থাকায় অভিযুক্ত করা হয়েছে আরেক ব্যক্তিকে। পরে সেই ব্যক্তি উচ্চ আদালতে আবেদন করলে দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত নিয়ে ঐ ব্যক্তির অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারতো। ইতিপূর্বে ২০০৭ সালের ২২ শে অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বি.এইচ.আর.এফ ইতিপূর্বে চট্টগ্রামের বিজয় রুদ্র নামক এক বিদ্যুৎ শ্রমিকের সাজা হলে তথ্যানুসন্ধান করে দেখে যে, আসলে যে নিরাপরাধ, তাঁর নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে জাল পাসপোর্ট দিয়ে শার্শা থানায় চোরাচালান আমল নং-৩১(০১)৯৮ এ সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামী অপু চন্দ্রের স্থলে তাকে প্রেরণ করে, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বি.এইচ.আর.এফ তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-বি.এইচ.আর.এফ চেয়ারপার্সন এডভোকেট এলিনা খান চাঞ্চল্যকর মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত নির্দোষ শাহ আলম বাবু ওরফে সুন্দর বাবুকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন ।এই ২০২১ এর জানুয়ারিতে কাশিমপুর কারাগার থেকে আরমান নামের এক ব্যক্তিকে খালাস করা হয়, যিনি ২০১৬ সাল থেকে কারাগারে ৫ বছর ছিলেন শুধুমাত্র বাবার নামের সাথে মিলের কারণে ।
২০০৫ সালে বিস্ফোরক আইনে করা একটি মামলায় একজন আসামির বাবার নাম আর মিরপুরের বাসিন্দা আরমানের বাবার নাম একই । ঐ মামলায় আসামীকে ২০১২ সালে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।ঐ মামলার মূল আসামী সে সময় পলাতক ছিলেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাবার নাম একই থাকার কারণে ২০১৬ সালে মিরপুর থেকে আরমানকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে এই বিষয়ে আরমানের পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে রিট করা হয় এবং চূড়ান্ত শুনানি শেষে আদালত আরমানকে খালাসের রায় দেন।এই ঘটনায় আরমানকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার এবং আরমানকে আটকের ঘটনার দায় নিরূপণে নতুন করে তদন্তের সিদ্ধান্ত দেন আদালত।
গত ১৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরে হঠাৎ আব্দুর রাশিদের বাড়িতে হাজির হন মনোহরদী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওমর ফারুক।ভুয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় চার দিন কারাগারে থেকেছেন আব্দুর রাশিদ নামে ৬৫ বছর বয়সী এক কৃষক। পাঁচ সন্তানের জনক ওই কৃষক নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার তারাকান্দি গ্রামের বাসিন্দা।
গত বছরের ৭ ডিসেম্বর মেঘনাপাড়ে ব্লকের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন লিটন, এমন সময় মঙ্গল সিকদার পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের এসআই জসিম উদ্দিন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যান। কেবল নামের মিল থাকায় বিনাদোষে ৯ মাস ধরে কারাগারে আছেন ভোলার লালমোহনের এক দিনমজুর। চেক ডিজঅনার মামলায় গলাচিপা পৌর এলাকার মুজিবনগর রোডের সাজাপ্রাপ্ত মো. হাবিবুর রহমানের স্থলে পৌর এলাকার কলেজপাড়ার বনানি এলাকার ৮০ বছরের নিরপরাধ বৃদ্ধকে জেলে পাঠায় পুলিশ।নামের মিল থাকায় বিনা অপরাধে সাতদিন কারাভোগ শেষে মুক্তি পেয়েছেন পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান (৮০)।
২৩ অক্টোবর গভীর রাতে দেওয়ানগঞ্জ থানার এসআই শহিজল হকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘুম থেকে তুলে ধরে নিয়ে যায় কৃষক রেজবুল হাসান লিটনকে (২৪)। শুধু নামে আংশিক মিল থাকায় গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে দেওয়ানগঞ্জ পৌর এলাকার রেজবুল হাসান লিটনকে। এর প্রতিকার চেয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জামালপুর পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
২০০০ সালের ১৬ জুলাই নগরের কোতোয়ালি থানার লালদীঘির পাড় এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়। ডাকাতি মামলার আসামির সঙ্গে নামের মিল। বাবার নামও একই। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা ভিন্ন। তবে নামের মিল থাকার খেসারত দিতে হলো কুমিল্লার লেপ-তোশকের দোকানি মো. ইউনুছকে (৫৫)। পুলিশের ভুলে বিনা দোষে কারাভোগ করলেন ৫৮ দিন। অবশেষে আদালতের নির্দেশে মুক্তি পেলেন । বাদী নেই-আসামি আছে। মামলার কোনো অস্তিত্ব নেই-অথচ গ্রেফতারি পরোওয়ানা আছে। থানায় সাধারণ ডায়েরি পর্যন্ত নেই-কিন্তু জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে মাসের পর মাস। এমন অদ্ভুত আইন ও বিচার ব্যবস্থাপনার গ্যাড়াকলে পড়ে হাজারও নিরীহ নিরপরাধ মানুষ আছেন দৌড়ের ওপর। একের পর এক মামলা দেখিয়ে অনেককে প্রডাকশন ওয়ারেন্টের আওতায় নেয়া হচ্ছে এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে। এক আদালত থেকে অন্য আদালতে। এমন দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি।
বাংলাদেশে বিনা দোষে কারাদণ্ড ভোগ করার ঘটনা প্রচুর হলেও ভূয়া ওয়ারেন্ট ও নাম বিভ্রান্তের কারণে নিরীহ লোকজনকে হয়রানীর ঘটনাও কম নয় । বিবৃতিদাতা মানবাধিকার নেতৃবৃন্দ এ সকল মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিগ্রস্থদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা নিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।